অগ্নিভ ভৌমিক, বিশেষ সংবাদদাতা :- পুরনো বিবাদ ভুলে, সূচনা হল ভারত-চীন সম্পর্কের নতুন যুগের। আগেই বলে দেওয়া হয়েছিল ‘কাশ্মীর প্রসঙ্গ’ নিয়ে কোন আলোচনায় হবে না ‘মোদি-শি’ বৈঠকে। সেই মত বৈঠকে ‘কাশ্মীর প্রসঙ্গ’ই ওঠেনি। কিন্তু সূচনা হল ভারত-চীন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি নতুন যুগের। দুই দিনের এই বৈঠকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় যেমন সুরক্ষা, সীমান্তে সন্ত্রাস দমন, বাণিজ্য, পর্যটন, যোগাযোগ ইত্যাদি। দুই প্রতিবেশী দেশ একযোগে সন্ত্রাস দমনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করার অঙ্গিকার করে। পুরনো মন কষাকষি দূরে রেখে, এই বৈঠক যে ভারত-চিন সম্পর্ককে আরোও জোরদার করবে, তা বলাবাহুল্য।
চেন্নাইয়ের মমল্লপুরমের সমুদ্রসৈকতের কাছে একটি রিসর্টে এই বৈঠক হয়। শুক্র ও শনিবার, দুই দিনের এই দীর্ঘ বৈঠকের পর দুই পক্ষই বেজায় খুশি। বৈঠক শেষে মোদির মুখে ‘বৈঠক সাফল্যে’র কথা শোনা যায়। তিনি বলেন, ‘‘বৈঠক সাফল্যমন্ডিত হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “উহানের শীর্ষ সম্মেলন ভারত ও চিনের পারস্পরিক বিশ্বাস ও সম্পর্ককে জোরদার করতে বড় ভূমিকা নিয়েছিল। আর চেন্নাইয়ের এই বৈঠকে দু’দেশই পারস্পরিক সম্পর্কে একটি নতুন যুগ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’’ ভোলেননি চিনের প্রসিডেন্টকে ধন্যবাদ জানাতেও। টুইট বার্তায় তিনি চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিংকে ধন্যবাদ জানান দ্বিতীয়বার ভারতে এসে ভারত-চিন সম্পর্কের নতুন যুগের সূচনা করার জন্য।
পরে অবশ্য বিদেশ সচিব বিজয় গোখলেও সাংবাদিক সম্মেলনে বৈঠক সাফল্যের কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে বৈঠক সেরে নেপাল রওনা হওয়ার আগে চিনা প্রেসিডেন্ট জানিয়ে গিয়েছেন বৈঠকে তিনি খুব খুশি। দু’দেশের সম্পর্কে একটি নতুন যুগ শুরু হতে চলেছে।’’
শুক্রবার রাতের বৈঠক সম্পর্কে চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং মোদীর সুরে সুর মিলিয়েই বলেছেন, ‘‘গত কাল প্রধানমন্ত্রীর (নরেন্দ্র মোদী) সঙ্গে আমার বন্ধুর মতো কথা হয়েছে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে কথা হয়েছে খুবই আন্তরিক ভাবে। নতুন যুগ শুরু হল দু’দেশের সম্পর্কে।’’
বলাবাহুল্য কশ্মির নিয়ে এই বৈঠকে কোন আলোচনা হয়নি। অবশ্য বুধবার ভারতের শীর্ষ কর্তারা জানিয়ে দিয়েছিলেন যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে থেকে কাশ্মীরের প্রসঙ্গ তুলবেন না, তবে রাষ্ট্রপতি শি চিনফিং বিষয়টি উত্থাপন করলে মোদী দিল্লির অবস্থান ব্যাখ্যা করবেন। পরে বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র রবিশ কুমার বলেছিলেন, “জম্মু-কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ, আর এনিয়ে ভারতের অবস্থান সঙ্গতিপূর্ণ এবং স্পষ্ট। চীন খুব ভালোই জানে আমাদের অবস্থান।” তবে বৈঠক শেষে শি চিনফিং-এর প্রতিক্রিয়া দেখে বোঝা যাচ্ছে, আগামী দিনে কাশ্মির নিয়ে চিনের পক্ষ থেকে বড়ো কোন বিরোধিতা আসবে বলে মনে হয়না।
প্রসঙ্গত কাশ্মিরের ৩৭০ ধারা বাতিল হওয়ার পর থেকেই ভারত-চিন সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়ে। এই ইস্যু নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে চিন বিভিন্ন ভাবে ভারতকে চাপে ফেলার চেষ্টাও করে। লাদাখের সঙ্গে চীনের বিরোধীয় সীমান্ত থাকায়, নয়াদিল্লি তার আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে বলেও দাবী করেছিল চিন। এছাড়াও অতীতে ‘পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করা’ নিয়ে ভারত-চিন সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। এমনকি গত বছর ‘ডোকলাম ইস্যু’ নিয়ে দু’দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে ৭৩ দিনের চাপানউতরে, ভারত-চিন সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তাই চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং- এর আচমকা এই বেসরকারি সফর ছিল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
তবে বিগতে দুদিনে আন্তর্জাতিক স্তরের সমস্ত বিবাদ ভুলে গিয়ে নতুন যুগের সূচনা হয় ভারত-চিন সম্পর্কের। কূটনিতিবীদরা, এই সফর নিঃসন্দেহে পাকিস্তানের জন্য বার্তাবহ বলে মনে করছে। কারণ এই বৈঠকে ‘সীমান্তে সন্ত্রাস দমন’ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। শুক্রবার রাতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিদেশ মন্ত্রকের তরফে বলা হয়, ‘‘কট্টরপন্থা ও সন্ত্রাসবাদকে সাধারণ চ্যালেঞ্জ হিসাবে বিবেচনা করে ভারত ও চিন তার বিরুদ্ধে এক সঙ্গে লড়াই করতে রাজি হয়েছে।’’ দুই দেশের বহুস্তরীয় সংস্কৃতি ও সমাজক যাতে সন্ত্রাসবাদের হাতে নষ্ট না হয়ে যায় তার জন্য দুই দেশ একত্রে কাজ করবে, বলে জানিয়েছেন বিদেশসচিব।
দুই দিনের এই বেসরকারি সফরে মোদি ও শি, তামিলনাড়ুর বিভিন্ন মন্দির ঘুরে দেখেন, একসাথে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করেন। গত কাল মমল্লপুরমে প্রাচীন মন্দির পরিদর্শনের ফাঁকে ডাবে চুমুক দিতে দিতে অথবা মন্দিরের নৃত্যানুষ্ঠানের অবসরে দোভাষীদের সঙ্গে নিয়ে একনাগাড়ে কথা বলতেও দেখা গিয়েছেন মোদী এবং শি’কে। এ দিন মধ্যাহ্নভোজ সেরেই নেপালের বিমান ধরার জন্য রওনা হয়ে যান চিনা প্রেসিডেন্ট।